এটাই হোক তাঁর পদক: মাহেরিন মেডেল ফর সিভিলিয়ান স্যাক্রিফাইস

 25 July 2025



সাম্প্রতিক সময়ে আমার মামাতো বোন এক ট্র্যাজেডিতে মারা গেছে।কিন্তু আসল ট্র্যাজেডি হলো—বাংলাদেশে এমন আত্মত্যাগের জন্য কোনো সম্মাননা নেই। 


মাহেরিন শুধু আমার পরিচিত একটি নাম ছিল না—সে ছিল আমার পরিবার। আমার মামাতো বোন। আমার মায়ের ভাইয়ের মেয়ে। ভাগ্য আমাদের দুই মহাদেশে (আমি আমেরিকায়, সে বাংলাদেশে) টেনে নিয়ে গেলেও সম্প্রতি আমাদের দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল । 


২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর, আমি ঢাকায় আরও বেশি সময় কাটাতে শুরু করি। দেশ যেন ডাকছিল, আর আমি একটা ছোট্ট ভূমিকা নিতে পেরে তৃপ্ত ছিলাম । আরও বেশি করে ফিরতে শুরু করলে, মাহেরিন আর আমি—যেভাবে অনেক মামাতো-ফুফাতো ভাইবোন করে—আবার নিজেদের নতুন করে খুঁজে পেলাম। শুরুটা হয়েছিল মেসেজ, তারপর ফোন। তারপর একদিন সে তার উত্তরার বাসায় আমাদের পুরো পরিবারকে দাওয়াত কর। উত্তর আমেরিকা থেকে আমাদের দুই খালা এসেছিলেন। আমাদের বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই, তাই মাহেরিন উপলব্ধি করেছিল—এটা সেই মুহূর্ত, যখন সবাইকে একসাথে করে কিছু শূন্যস্থান পূরণ করা যায়।


আমি এখনো মনে করতে পারি, তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার মুহূর্তেই ঘরের মশলার গন্ধে মনটা থেমে গিয়েছিল—যে ধরনের গন্ধ সময়কে থামিয়ে দেয়, অতীত কে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কয়েক ঘণ্টার জন্য, আমরা যেন এমন এক জগতে ফিরে গিয়েছিলাম, যেখানে ভাইবোন মানে সেরা বন্ধু। সেদিন রাতে, আমরা আবার দশ বছর বয়সী শিশুর মতো হেসেছিলাম। 


এরপর নিয়মিত কথা হতো। দুর্ঘটনার আগের দিন সে আমাকে ফোন করেছিল। হঠাৎ ফোন। ওর কত পরিকল্পনা ছিল! আমাদের তার পরের বৃহস্পতিবার দেখা করার কথা ছিল। আমি আমেরিকা থেকে সদ্য ফিরেছি, খাবারে বিষক্রিয়ায় অসুস্থ, কিন্তু আমার দেশে ফিরে আসাতে তাকে খুবই খুশি আর প্রাণবন্ত শোনাচ্ছিল - একদম জীবন্ত। 


তারপরই, সে নেই।


পরদিন, দুপুর দুইটার দিকে, অসুস্থ অবস্থায়ও কাজে যাচ্ছি ,   গাড়ির সিটে বসার সময় বাইরে একজন মোটরসাইকেল আরোহীকে জোরে ফোনে কথা বলতে শুনলাম “একটা প্লেন একটা স্কুলে ক্র্যাশ করেছে।” 


ওর স্কুল। আমার শরীর হিম হয়ে গেল। 


তৎক্ষণাৎ আমি তাকে ফোন দিলাম। কোনো সাড়া নেই। আবার ফোন দিলাম। বারবার দিলাম। পরে বুঝতে পেরেছিলাম—তার ফোনটা সম্ভবত আগুনে গলে গিয়েছিল। 


আমি আতঙ্কিত হয়ে আমার স্ত্রীকে ফোন করলাম, পরিবারে খোঁজ নিতে বললাম। খবর নিতে বললাম। না, এমন কিছু হয়নি—এটা শুনতে চাইলাম। হয়তো সে বাইরে গিয়েছিল, হয়তো সেদিন দেরি করে এসেছিল। হয়তো... 


কিন্তু আমরা দুজনেই জানতাম বাস্তবতা সেটা নয়।


সে মারা গেছে। কারণ সে সবসময় যা করত—অন্যদের পাশে দাঁড়ানো , তাদের রক্ষা করা—সেটাই করছিল। 


মাহেরিন কোনো যুদ্ধে মারা যায়নি। সে কোনো রাজনৈতিক দলের ছিল না। সে মিছিল করেনি। সে লবিং করেনি। সে ট্রেন্ড করেনি। সে শুধু... ভালোভাবে বেঁচে ছিল। প্রাণঢালা ভালোবাসত। নিভৃতে কাজ করত। আর যখন অকল্পনীয় কিছু ঘটে গেল, সে পালিয়ে যায়নি। সে ছিল এবং সে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই চলে গেল। 


সে এখন একটি খবরের শিরোনাম হয়ে গেছে, যেটা কিছুদিন পর হয়তো আর কেউ মনে রাখবে না । কিন্তু বাংলাদেশে এমন মানুষের জন্য পর্যাপ্ত কোনো সম্মান  এখনো নেই। আমাদের আছে যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসের জন্য পদক, আছে রাজনীতি আর রক্ষাকর্তৃত্বের অনেক ট্রফি। আছে সম্মানসূচক খেতাব যাদের আছে পরিচিতি, তাদের জন্য। কিন্তু আমাদের কিছুই নেই সাধারণ নাগরিকদের জন্য, যারা কোনো হইচই ছাড়াই নির্দ্বিধায় নিজের জীবন দেয়। 


আমরা বলি, আমরা ত্যাগকে সম্মান করি, কিন্তু মনে হয় এটা তখনই করি, যখন সেটা সুবিধাজনক, ঐতিহাসিক, কিংবা লাইভ টেলিভিশনে দেখানো যায়। 


এটি হোক তার পদক, এখনই সময় পরিবর্তনের। 


আমি চাইছি একটি জাতীয় বেসামরিক পুরস্কার—যেটা শুধু তাদের জন্য, যারা নিঃস্বার্থভাবে অন্যের সেবায় নিজের জীবন দেয়। তাদের জন্য নয় যারা শুধু ভাল কাজ করেছেন, কিংবা দীর্ঘদিন কোনো পদে ছিলেন,। কেবল তাদের জন্য, যারা নিঃশব্দ সাহসিকতা আর নৈতিক দায়িত্ব থেকে জীবন দিয়েছেন। 


এই পদকের নাম হোক: “মাহেরিন পদক”—বেসামরিক আত্মত্যাগের জন্য এবং এতে একটি অটুট শর্ত থাকুক: 

“কোনো রাজনৈতিক সংযোগ নয়,কোনো দলের মনোনয়ন নয় ... নয় কোনো পিছনের দরজার সমঝোতা।”


এটা যেন আরেকটা লাল ফিতা হয়ে না যায়, ২৬শে মার্চের ভাষণে যাদের পরিচিত আছে, তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।


এটি দেওয়া হোক— 


• সেই শিক্ষীকাকে, যিনি ছাত্রদের আগুন থেকে বাঁচাতে নিজে ঝুঁকি নিয়েছেন।  

• সেই স্বাস্থ্যকর্মীকে, যিনি মহামারির সময় সেবা দিতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি।  

• সেই নাগরিককে, যে বন্যা, অগ্নিকাণ্ড, কিংবা দুর্ঘটনায় জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়েছেন। 


যারা কখনো পদকের জন্য কিছুই চাননি, এবং আর কোনোদিন নিতে পারবেন না—তাদের জন্য হোক এই মাহেরিন পদক । 


এই পদক শোকের নয় হোক দায়িত্বের। 


আরেকটা মনুমেন্ট আমাদের দরকার নেই। 

আমাদের দরকার, স্মৃতি,আমাদের দরকার, জবাবদিহি। আমাদের দরকার সন্তানদের শেখানো—আসল ত্যাগ কি। 


মাহেরিন শুধুই মারা যায়নি, সে জীবন দিয়েছে—নিজের অতি প্রিয় কর্মক্ষেত্রে এক চূড়ান্ত কর্তব্যের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে। 


এটাই হোক তার পদক। তার নাম থাকুক তালিকার শুরুর দিকে। তবে সেই তালিকা যেন বড় না হয় কখনো—তবু কখনো শূন্য না থাকে।

Comments

Popular posts from this blog

Let This Be Her Medal: The Maherin Medal for Civilian Sacrifice

From Resilience to Reinvention: Forging a New Era in U.S.-Bangladesh Relations

Recognise All the Founding Fathers — Not Just One Man